উপকূলীয় বনায়নের ধারণা
বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে লবণাক্ততা ও উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে প্রাকৃতিক বন রক্ষা ও সৃষ্টি হুমকীর মুখে পতিত হয়েছে। এসব উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য সারা দেশের পরিবেশের উপর নানা ভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে । এজন্য বিস্তৃর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা রোধী, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে টিকে থাকতে পারে এমন বৃক্ষ প্রজাতি রোপণ এবং লবণাক্ততা সহ্যকারী ফসলের চাষ করে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী সৃষ্টি করা আবশ্যক । এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে মানুষ, পশু-পাখি ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা ছাড়াও উপকূলবাসী আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবে ।
উপকূলীয় বনায়নের জন্য ব্যবহৃত গাছের বৈশিষ্ট্য (ঝাউ গাছ ও দেবদারু গাছ)
উপকূলীয় বনাঞ্চলকে লোনামাটির অঞ্চলও বলা হয় । লোনা মাটির অঞ্চল বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, বরিশালের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা ও তৎসংলগ্ন জেগে উঠা চরাঞ্চলসমূহ । এসব অঞ্চলের প্রধান প্রধান বৃক্ষ প্রজাতিসমূহ - নারিকেল, আমড়া, খেজুর, বাবলা, কাজুবাদাম, শিরিষ, রেইনট্রি, তাল, তেঁতুল, সুপারি, জলপাই ইত্যাদি। তবে উপকূলীয় অঞ্চলের উদ্ভিদ হিসাবে ঝাউ ও দেবদারু গাছও উল্লেখযোগ্য। এসব উদ্ভিদের মরুজ বৈশিষ্ট্য থাকায় লবণাক্ততা সহ্য করে উপকূলীয় আবহাওয়ার সাথে সহজে খাপখাইয়ে নিতে পারে । উপকূলীয় অঞ্চলের অধিক লোনাযুক্ত মাটিতে সুন্দরি, গেওয়া, কেওড়া, কাঁকড়া, বাইন, গরান, গোলপাতা ইত্যাদি ভালো জন্মে । লবণাক্ততার সাথে খাপখাওয়াতে এসব উদ্ভিদের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
ঝাউ গাছ
বর্ণনা : ঝাউ বৃহদাকার চিরসবুজ বৃক্ষ। উচ্চতা ১৫-১৮ মিটারের মতো হয়ে থাকে । বাকল বাদামি ও অমসৃণ । কাঠ খুব শক্ত তবে ফেটে যায় । মে মাসে ফুল হয় । ফল পাকতে এক বছর সময় লাগে । ঝাউ গাছ বনায়নের জন্য বেলেমাটি খুবই কার্যকরী ।
প্রাপ্তিস্থান : প্রধানত উপকূলীয় এলাকা তবে দেশের বিভিন্ন স্থানেও ঝাউ গাছ জন্মে থাকে ।
বীজ : মে-জুন মাসে-বীজ সংগ্রহ করা হয় ।
চারা উত্তোলন : ফেব্রুয়ারি মাসে ঝাউয়ের চারা উত্তোলন করা হয় ।
বীজ সংগ্রহ পদ্ধতি : ফল সরাসরি গাছ থেকে পাড়তে হয় । ডালের গোড়ার ফল ভালো পরিপক্ক হয় তাই এ ফল সংগ্রহ করা উত্তম । ২-৩ দিন রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে মাড়াই করে বীজ থেকে খোসা আলাদা করা হয় ।
বীজ সংরক্ষণ : বীজ রোদে শুকিয়ে বায়ুরোধক পাত্রে ৫-৭ মাস সংরক্ষণ করা যায় ।
বীজ বপন পদ্ধতি
জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মাসে বীজতলায় অথবা পলিব্যাগে বীজ বপন করা হয়। বীজতলা ও পলিব্যাগে পরিশোধিত বালির সাথে মিশিয়ে বীজ বপন করা সুবিধাজনক । বীজ গজাতে ২৫-৩০ দিন সময় লাগে । চারা গজানোর আগেই ছায়া প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ৪০-৫০ দিন পর ছায়া প্রদানের ব্যবস্থা সরিয়ে ফেলতে হবে ।
চারা বাছাই ও রোপণ পদ্ধতি
বীজতলায় অতিরিক্ত চারা গজালে কিছু চারা তুলে ফেলতে হয় । আগাছা বাছাই করতে হয় । পলিব্যাগে চারার শিকড় পলিব্যাগের বাইরে এলে কেটে দিতে হয় । ঝাউ গাছ দ্রুত বর্ধনশীল গাছ । ৬ মাস বয়সী বড় চারা রোপণ করা উত্তম । বালিয়াড়ি ও লোনা মাটিতে ঝাউ গাছ ভালো হয়। এ জন্য উপকূলীয় অঞ্চলের বনায়নের ঝাউ গাছ লাগানো হয় ।
ব্যবহার
কোনাকৃতি বিশিষ্ট হওয়ায় সৌন্দর্যের জন্য সড়ক, মহাসড়কের পাশে রোপণ করা হয় । মাটিতে নাইট্রোজেন উৎপাদনের ক্ষমতা থাকায় এ গাছ উপকূলীয় অঞ্চলে বেশি লাগানো হয় । জ্বালানি হিসাবে এ কাঠ উৎকৃষ্ট । কাঠ খুব শক্ত তাই খুঁটি ও খড়িকাঠ হিসাবেও ব্যবহার হয় ।
দেবদারু
বর্ণনা : চির হরিৎ বৃক্ষ, কাণ্ড মোটা, সোজা ও অতি উঁচু হয় । সাধারণত শোভাবর্ধন হিসাবে রোপণ করা হয়ে থাকে । গাছ ৫০-৬০ মিটার লম্বা হয় এবং ৫০০-৬০০ বছর পর্যন্ত জীবিত থাকে । পাতাগুলো গাঢ় সবুজ, যৌগিক, দেখতে অনেকটা বর্শার মতো কিন্তু কিনারা ঢেউ খেলানো । সাধারণত অক্টোবর মাসে ফুল হয়, ফল পাকে দেরিতে । বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এ গাছ পাওয়া যায় ।
বীজ সংগ্রহের সময় : জুলাই-আগস্ট ।
বীজ সংগ্রহ পদ্ধতি : পাকা ফল কালো রঙের হয়। ফল পাকলে গাছ থেকে বা গাছ তলা থেকে সংগ্রহ করে বস্তায় রেখে পচিয়ে পানিতে ধুয়ে বীজ সংগ্রহ করতে হয় । দেবদারু বীজ সংরক্ষণ করা যায় না বলে সংগ্রহ করার সাথে সাথে তা বীজ তলায় বা পলিব্যাগে বপন করতে হয় ।
বীজ বপন পদ্ধতি : প্রতি পলিব্যাগে ২টি করে বীজ বপন করতে হয় । প্রাথমিকভাবে ছায়ার ব্যবস্থা করতে হয় । বীজের অঙ্কুরোদগম হার শতকরা ৯০ ভাগ । ৭-১৫ দিনের মধ্যে অঙ্কুরোদগম সম্পন্ন হয় ।
রোপণের সময় চারার বয়স : দেড় থেকে দুই বছর বয়সের চারা সড়কের পাশে, বাগানের ও উপকূলীয় অঞ্চলে জুন-জুলাই মাসে রোপণ করা উত্তম ।
ব্যবহার : দেবদারু কাঠ হালকা ও নরম । টিনের ধারের ফ্রেম, পাটাতন, দেশলাই ও প্যাকিং বক্স তৈরিতে দেবদারু কাঠ ব্যবহার হয় । কাগজের মণ্ড তৈরিতেও দেবদারু কাঠ ব্যবহৃত হয় ।
উপকূলীয় বনায়নের উপযোগিতা
উপকূলীয় বনায়নের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী তৈরি ও তা সংরক্ষণ করা গেলে বহুবিধ উপকার সাধিত হবে। উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষা ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন ও টর্নেডোর প্রকোপ থেকে উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষা করা । জ্বালানি ও খাদ্যের চাহিদা মোটানো, অর্থ উপার্জন, ভূমিক্ষয় রোধ ইত্যাদি প্রয়োজনে উপকূলীয় বনায়ন সৃষ্টি ও তা রক্ষণাবেক্ষণ করা একান্ত অপরিহার্য । উপকূলীয় বনাঞ্চলের উপযোগিতা সমূহ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নিম্নরূপ উপায়ে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে ।
ক) পরিবেশগত উপযোগিতা
খ) নান্দনিক উপযোগিতা
উপকূলীয় বনায়নের ফলে যে নির্মল সবুজ বেষ্টনী তৈরি হয় তার নান্দনিক সৌন্দর্য অভূতপূর্ব । এ সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে দেশ-বিদেশের বহু ভ্রমণ বিলাসী মানুষের সমাগম ঘটে । হরেক রকম পশুপাখির আবাসস্থল তৈরি হয় যা পরিবেশের অসীম উপকার সাধন করে এবং নান্দনিকতায় নবতর সংযোজন ঘটায় ।
গ) অর্থনৈতিক উপযোগিতা
কাজ : শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে উপকূলীয় বনায়নের উপযোগিতা বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে। |
আরও দেখুন...